প্রিয় পাঠক আজকে আমরা বানান কাকে বলে | বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা বানানের নিয়ম নিয়ে জানব। আশা করি শেষ পর্যন্ত সাথে থাকবেন। চলেন তাহলে শুরু করা যাক…
বানান কাকে বলে | বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা বানানের নিয়ম
বানান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘বর্ণং (বর্ণন)’ থেকে যার অর্থ ‘শব্দের মধ্যস্থিত বর্ণসমূহের ক্রমবর্ণনা’ । বাংলা বানান বলতে বোঝায় বাংলায় ব্যবহৃত শব্দে বর্ণসমূহের ক্রমানুক্রমিক বর্ণনা ।
বাংলা বানানের ইতিবৃত্ত
বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি এবং প্রকাশ মাধ্যম বাংলাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের পর বাংলা ভাষা বিশ্ব সাহিত্যের সম্মানজনক স্থান অধিকার করে নেয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বিশ্বে বাংলা ভাষার মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক উন্নত দেশের বিখ্যাত সাহিত্যিকগণ বাংলা ভাষা শিখে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করছেন। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দরদ ও সচেতনতা প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আর তাই বাংলা বানানের প্রতি আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছি না ।
বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তির অন্ত নেই। এটি যত না ভাষাগত, তার চেয়ে অধিক পণ্ডিতগণের অভিমতগত। বিভিন্ন পণ্ডিত বাংলা
শব্দের বানানে নিজস্ব মতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলা শব্দের বানানের আদর্শ রীতি প্রতিষ্ঠাকে দুরূহ করে তুলেছেন। উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা বানানের নিয়ম বলতে কিছু ছিল না। তখন মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন অনুযায়ী বাংলা তৎসম শব্দের বানান নির্ধারিত হতো।
১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিছু শব্দের বানানের নিয়ম বেঁধে দেয়, বাংলা বানানের বিশৃঙ্খল অবস্থা অবসানের জন্য রবীন্দ্রনাথের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রাজশেখর বসুর সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি ১৯৩৬ সালের মে ও অক্টোবর মাসে বানান সম্পর্কিত পুস্তিকার প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণ এবং ১৯৩৭ সালে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে ।
এই প্রচেষ্টা ছিল সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবাত্মক যদিও এর ভূমিকায় উল্লেখ ছিল যে, সমিতি কেবল যেসব বানানে ঐকা নেই সেসব বানান যথাসম্ভব নির্দিষ্ট করা এবং যদি সম্ভব হয় তবে কোনো কোনো স্থলে প্রচলিত বানান সংস্কার করা । ভাতে কিছু রক্ষণশীল পণ্ডিত বিরোধিতা করলেও রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রসহ অধিকাংশ পণ্ডিত ও লেখক সেসব নিয়ম সমর্থন করেন। যদিও পরবর্তী সময়ে বিশ্বভারতী তাদের নিজস্ব বানানের নিয়ম বের করে বিভ্রান্তি জিইয়ে রাখে ।
পাঠ্যপুস্তকে বানানের সমতাবিধানের উদ্দেশ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৪ সালে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। যারা অভিন্ন বানানের জন্য কিছু নিয়ম সুপারিশ করেন। নানা কারণে সে নিয়ম বহুল প্রচলিত হয়নি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে কুমিল্লায় একটি কর্মশিবিরের আয়োজন করে বাংলা বানানে সমতা বিধানের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে।
সে নীতিমালা মোতাবেক ড. আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে বাংলা বানানের নিয়ম ও শব্দ তালিকা চূড়ান্ত করা হয় এবং ১৯৯২ সালে ‘পাঠা বইয়ের বানান’ নামে একটি পুস্তিকা বের হয়। বাংলা একাডেমি আবার ড. আনিসুজ্জামানকেই সভাপতি করে বানানের নিয়মগুলো সূত্রবদ্ধ করার জন্য কমিটি গঠন করে। এ কমিটি বিশ্বভারতী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রবর্তিত পাঠ্য বইয়ের বানানরীতিকে সমন্বিত করে একটি অভিন্ন বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেন, যা বাংলা একাডেমির ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ বলে পরিচিত। যার প্রথম প্রকাশ
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর এবং পরিমার্জিত সংস্করণ ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি উক্ত নিয়ম অনুসরণ করে একই কমিটির অন্যতম সদস্য জামিল চৌধুরী প্রণয়ন করেন বাংলা বানান-অভিধান’। ১৯৯৪ সালের জুনে বাংলা একাডেমি এটি প্রকাশ করে। বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকার জন্য বাংলাদেশের সমসাময়িক সাহিত্য এবং পত্র-পত্রিকায় ওই বানানকে ‘প্রমিত’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
ব্যাকরণে বানানরীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো ভাষায় লেখার সময় বানান সঠিক হওয়া প্রয়োজন বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষার বানান নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে একসময় বানানের নিয়মনীতি বলতে কোনো কিছুই ছিল না। মোটামুটি উনিশ শতকের শুরু থেকেই বানান সম্পর্কে সচেতনতা লক্ষ করা যায়। এ সময় সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী তৎসম শব্দের বানান নির্ধারিত হয়। কিন্তু তৎসম থেকে বিবর্তিত যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় সেগুলোর জন্য কোনো নিয়ম তৈরি সম্ভব হয়নি।
তাছাড়া মৌলিক শব্দের বানান কেমন হবে, যৌগিক শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে বানান কীভাবে হবে সে সম্পর্কে নিয়ম ছিল না। বাংলা গদ্যে চলিত রীতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় একই শব্দে বানান ভিন্নতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। বিশ শতকের বিশের দশকে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চলিত ভাষাৰ বানানের নিয়ম তৈরি করেন। বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলি ঐ বানানরীতি অনুসারে ছাপা হতে থাকে ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত বাংলা বানানের নিয়ম
বাংলা ভাষা বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষা হলেও তার মান রূপটি শেখার জন্য মনোযোগ, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম দরকার। সর্বোপরি। দরকার মেধা। কিন্তু নিজস্ব ভাষা হওয়ায় অনেকের মধ্যে পরিশ্রম, মেধা-মনন ও স্মৃতিশক্তি থাকার পরও তা কাজে না লাগানোর মানসিকতা লক্ষ করা যায়। বাংলা বানানের বহুবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসমতা, বিশৃঙ্খলা লক্ষ করে বিশ শতকের প্রথমার্ধেই পণ্ডিত, লেখক, শিক্ষকগণ বাংলা বানান সংরক্ষণ এবং সঠিক কাঠামো বেঁধে দেওয়ার কাজ হাতে নেন। বিভিন্ন অভিধান, শব্দকোষ ও
ব্যাকরণের মধ্যে তা প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯৩৫ সালে বাংলা বানান সংস্কার কমিটি গঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে। ১৯৩৬ সালে তার প্রতিবেদন প্রকাশ পায় এবং ১৯৩৭ সালে কমিটি বাংলা বানানের নিয়ম শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এর মধ্যে পুস্তিকাটির কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় । তার মধ্যে তৃতীয় সংস্করণটাই বিশেষভাবে গৃহীত ও প্রচলিত কিছু নীতিমালা সামনে রেখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
বানান সংস্কার কমিটি বাংলা বানানের রূপরেখা তৈরি করে যেমন
১. সরল ও সহজ উচ্চারণরীতি গ্রহণযোগ্য।
২. উচ্চারণের সঠিক মান তৈরির জন্য বহু নির্দেশক চিহ্ন বা অক্ষর পরিতাজ্য
৩. উচ্চারণের প্রচলিত রীতি পরিবর্তন করা ঠিক হবে না। নয়।
৪. কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণ, যেমন- এখন, এমন এক প্রচলিতভাবে অ্যাখন, অ্যামন, এ্যাক হলেও এসব ক্ষেত্রে বানান পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই
৫. অঞ্চলভেদে শব্দের উচ্চারণ বানানে আনা ঠিক হবে না ।
৬. যেসব তৎসম শব্দ বাংলায় এসেছে সেসব বানান সংস্কৃত ব্যাকরণ ও অভিধান মোতাবেক থাকাই উচিত। ভাতে হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না।
৭. বিদেশি শব্দের বানান নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। ইচ্ছামতো নানাবিধ উচ্চারণ ও তার বানান বাঞ্ছনীয় ৮. সঠিক উচ্চারণভিত্তিক সঠিক বানানের অভিধান প্রণয়ন
৯. সব বাংলা শব্দের বানান অল্প সময়ে সঠিক করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক নয়, ক্রমান্বয়ে তা করতে হবে।
বানান সংস্কার কমিটির নির্ধারিত বানান ক্রমশ প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতি এসব প্রস্তাব বা নীতিমালা সব মহলে সাদরে গৃহীত হয়নি বরং জন্ম দিয়েছে বহুমুখী বিতর্ক ও সমস্যা। সমিতির প্রভাবশালী সদস্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাবা হরিদাস চট্টোপাধ্যায়সহ আরো অনেকেই বানান সংস্কার সমিতির বানানরীতির তীব্র বিরোধিতা করেন ।
অবশ্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশচন্দ্র রায় প্রমুখ পণ্ডিত বানান-সংস্কার সমিতির সঙ্গে কোথাও কোথাও দ্বিমত পোষণ করলেও তাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেননি । তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সংস্কার সমিতি প্রবর্তিত নিয়মই বর্তমানে আধুনিক বাংলা বানানের নিয়ম হিসেবে পরিচিত।
উপরে আমরা বানান কাকে বলে | বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা বানানের নিয়ম নিয়ে সামান্য ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছি। শেষ পর্যন্ত সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
আজকের টপিক রিলেটেড প্রশ্নঃ সঠিক বানান, বাংলা বানান, বানান কি, বানান সংশোধন, সঠিক বানান পরীক্ষা, দুরূহ বানান, উদযাপন এর সঠিক বানান, বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম, 1 থেকে 100 ইংরেজি বানান, 1 থেকে 100 বাংলা বানান, ৮৮ বাংলা বানান, ৫০ থেকে ১০০ পর্যন্ত বানান, 66 বাংলা বানান, বাংলা বানান ভুলের কারণ ও প্রতিকার, ছোটদের বাংলা বানান শিক্ষা, লক্ষ বানান, ইংরেজি শুদ্ধ বানান, মোসাম্মৎ ইংরেজি বানান,