মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার প্রবন্ধ | মাদকাসক্তি প্রতিরোধের উপায়

মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার প্রবন্ধ | মাদকাসক্তি প্রতিরোধের উপায়

মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার প্রবন্ধ | মাদকাসক্তি প্রতিরোধের উপায়: আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশ আজ এক সর্বনাশা মরণনেশার শিকার। সে নেশা মাদকের। যে তরুণের ঐতিহ্য রয়েছে সংগ্রামের, প্রতিবাদের, যুদ্ধজয়ের – আজ তারা নিঃস্ব হচ্ছে মরণনেশার করাল ছোবলে।

মাদকনেশার যন্ত্রণায় ধুঁকছে শত-সহস্র প্রাণ। ঘরে ঘরে সৃষ্টি হচ্ছে উদ্বেগ। ভাবিত হচ্ছে সমাজ। এ পরিস্থিতি মেনে নেওয়া যায় না।

সর্বনাশা নেশার উৎস নেশার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম, চরস, তামাকের নেশার কথা মানুষের অজানা নয়। কিন্তু সেকালে তা ছিল অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বেদনানাশক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত মাদক ‘ড্রাগ’ নামে পরিচিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নেশার উপকরণ হিসেবে ড্রাগের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর ইত্যাদি এলাকায় ড্রাগ তৈরির বিশাল বিশাল চক্র গড়ে ওঠে। ক্রমে বেদনানাশক ড্রাগ পাশ্চাত্যের ধনাঢ্য সমাজে নেশার উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে বিশ্বের দেশে দেশে মাদক মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে যন্ত্রণা ও মৃত্যুর দিকে।

বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ ও তাদের ব্যবহার : সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক ড্রাগ ব্যবসায়ীরা নানাধরনের মাদকের
ব্যবসা ফেঁদেছে। এসব মাদকের ব্যবহারের পদ্ধতিও নানারকম। ধূমপানের পদ্ধতি, নাকে শোকার পদ্ধতি, ইনজেকশনের মাধ্যমে ত্বকের নিচে গ্রহণের পদ্ধতি এবং

সরাসরি রক্তপ্রবাহে অনুপ্রবেশকরণ পদ্ধতি। বিভিন্ন রকম ড্রাগের মধ্যে হেরোইন আজ সব নেশাকেই ছাড়িয়ে গেছে। এর মাদকাসক্তিও অত্যন্ত তীব্র। নিছক কৌতূহলবশত যদি কেউ হেরোইন সেবন করে তবে এই নেশা সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো তার ঘাড়ে চেপে বসে।

মাদকাসক্তির পরিণাম কোনোভাবে একবার কেউ মাদকাসক্ত হলে অচিরেই নেশা তাকে পেয়ে বসে। সে
হয়ে পড়ে নেশার কারাগারে বন্দি। মাদকাসক্তির ফলে তার আচার-আচরণে দেখা যায় অস্বাভাবিকতা। তার চেহারার লাবণ্য হারিয়ে যায়। আসক্ত ব্যক্তি ছাত্র হলে তার বইপত্র হারিয়ে ফেলা,

পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাওয়া, মাদকের খরচ জোগাতে চুরি করা ইত্যাদি নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দেয়। নেশার জন্য প্রয়োজনীয় ড্রাপ না পেলে মাদকাসক্তরা প্রায়ই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। লোকের সঙ্গে এরা দুর্ব্যবহার করে। মাদকের প্রভাবে রোগীর শারীরিক প্রতিক্রিয়াও হয় নেতিবাচক। তার মননশক্তি দুর্বল হতে থাকে। তার শরীর ভেঙে পড়ে। ক্রমে স্নায়ু শিথিল ও অসাড় হয়ে আসে। এভাবে সে মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।


মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের কারণ : সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ক্ষেত্রে হতাশা ও দুঃখবোধ থেকে সাময়িক যস্তিলাভের আশা থেকেই এই মারাত্মক নেশা ক্রমবিস্তার লাভ করছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, অনেক দেশে বিপথগামী মানুষ ও বহুজাতিক সংস্থা উৎকট অর্থলালসায় বেছে নিয়েছে রমরমা মাদক ব্যবসার পথ। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বিভিন্ন দেশের মাফিয়া চক্র। মাদকের ঐ কারবারিরা সারা বিশ্বে তাদের ব্যবসায়িক ও হীনস্বার্থ রক্ষায় এই নেশা পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

মাদকাসক্তি প্রতিরোধ : বিশ্বজুড়ে যে মাদকবিষ ছড়িয়ে পড়ছে তার থাবা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন। সমাজসেবীরা উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। দেশে দেশে নানা সংস্থা ও সংগঠন মাদকবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে। আমাদের দেশেও মাদকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। বেতার, টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদি গণমাধ্যম মাদকবিরোধী জনমত গঠনে সক্রিয় হয়েছে।

মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে। এসব তৎপরতার লক্ষ্য হচ্ছে
১. মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ভেষজ ও মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ ২. সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে তরুণদের সম্পৃক্ত করে নেশার হাতছানি থেকে তাদের দূরে রাখা
৩. ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে মাদকাসক্তির মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে সকলকে সচেতন করা
৪. মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা ৫. বেকার যুবকদের জন্যে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি।


মাদকাসক্তির মতো সর্বনাশা নেশার করাল গ্রাসে পড়ে তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশ যেভাবে জীবনশক্তি হারিয়ে ফেলতে বসেছে তাতে সমাজ আজ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। এ মারাত্মক সমস্যা সম্পর্কে ঘরে ঘরে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। সুস্থ, সুন্দর, আনন্দ-উজ্জ্বল সমাজজীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাদকদ্রব্য ব্যবহার রোধ করার বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কঠোর হাতে দমন করা দরকার মাদকচক্রের হোতাদের। মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্তির করাল গ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব দল-মত নির্বিশেষে সবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *